গবেষণা ও শিক্ষণে প্যারাডাইম- Paradigm for research and teaching

গবেষণা ও শিক্ষণে প্যারাডাইম- Paradigm for research and teaching


গবেষণা ও শিক্ষণে প্যারাডাইম- Paradigm for research and teaching



গবেষণা ও শিক্ষণে প্যারাডাইম হলাে একটা ধারণাগত কাঠামাে(Conceptual Framework) যা গবেষণা পরিচালনার জন্য প্রয়ােজন। এটি একটি প্রতিষ্ঠিত মডেল বা নমুনা যা গবেষক কমুনিটির মাধ্যমে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত এবং অনেক বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রতিটি গবেষণাতেই যেকোনাে একটি প্যারাডাইম এর ধারা বা নিয়ম কানুন বা গাইডলাইন ব্যবহার করা হয় গবেষণার পদ্ধতি নির্ধারণের জন্য।

প্যারাডাইম শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘Paradeigma' হতে উদ্ভুত যার অর্থ হলাে নকশা বা প্যাটার্ণ (pattern)। এই শব্দটি সর্বপ্রথম ১৯৬২ সালে গবেষক ‘Kuhn' ধারণাগত কাঠামাে বর্ণনা করতে গিয়ে ব্যবহার করেন। এরপর থেকে বিজ্ঞানীদের মধ্যে কোন প্যারাডাইম সবচেয়ে ভালাে এটা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয় এবং ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তারা পরিমাণগত গবেষণাকেই বিশুদ্ধ বিজ্ঞান (pure science) ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের জন্য সবচেয়ে ভালাে বলে বিশ্বাস করতেন।

গবেষণা ও শিক্ষণে প্যারাডাইম এর প্রকারভেদ 

সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণার মূলত দুইটি প্রধান গবেষণা প্যারাডাইম হলাে পজিটিভিজম ও ইন্টারপ্রিটিভিজম প্যারাডাইম। তবে এই দুই প্যারাডাইম থেকে আরাে অনেক প্যারাডাইম সৃষ্টি হয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় প্যারাডাইম হলাে মিশ্র-পদ্ধতি প্যারাডাইম (MixedMethod paradigm) । 

পজিটিভিজম প্যারাডাইম (Positivism Paradigm) 

প্যারাডাইম এর প্রথম ধারাটি পজিটিভিস্টিক এপ্রােচ (Positivistic Approach) হিসেবে বিবেচিত। এই প্যারাডাইম অনুযায়ী নিরপেক্ষ ও নির্ভরযােগ্য সত্য জ্ঞান সৃষ্টি সম্ভব যা একযােগে সকলের কাছে গ্রহণযােগ্য। যখন কোনাে গবেষণায় এই ধারা প্রবর্তন করা প্রয়ােজন হয় তখন পূর্ব নির্বাচিত কাঠামাের মধ্যে এটি ফেলা যায় যা পূর্ব অনুমানযােগ্য। এই ধারায় গবেষক বা পর্যবেক্ষক অবশ্যই স্বাধীন বা মুক্ত। অর্থাৎ মানব আকাক্ষা বা ইচ্ছা এখানে মুখ্য নয়। হাইপােথিসিস এবং ডিডাকশন এর মাধ্যমে গবেষণা অগ্রসর হতে থাকে। ধারণা বা কনসেপ্ট অবশ্যই কার্যকর (Operationalised) হতে হবে যা পরিমাপযােগ্য। বিশ্লেষণ এর একক সহজ ও সরল ভাবে উপস্থাপিত হবে। পরিসংখ্যানিক সম্ভাব্যতার মাধ্যমে সাধারণীকরণ করা হয়। এর জন্য দৈবচয়নের মাধ্যমে বড় আকারের নমুনা হতে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।

পজিটিভিজম প্যারাডাইম এর বৈশিষ্ট্য 
১. বেশিরভাগ বৈজ্ঞানিক (Scientific) ও পরিমাণগত (Quantitative) গবেষণার ধারণার কাঠামাে (Conceptual Framework) হিসেবে পজিটিভিজম প্যারাডাইম ব্যবহার করা হয়। 
২. পরিমাণগত গবেষণা (Quantitative Research) সবসময় পজিটিভিস্ট এপ্রােচ অনুসরণ করে কারণ তারা হাইপােথিসিস টেস্টিং (Hypothesis Testing) এ বিশ্বাসী। 
৩. এই ধরনের গবেষণার ব্যাপ্তি বা পরিসর অনেক বড় হয়। 
৪. গবেষকের নিজস্ব মতামত প্রদানের সুযােগ থাকেনা যেহেতু এক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। 
৫. এই গবেষণা পরিমাণগত বা সংখ্যাবাচক তথ্যের (Quantitative Data) উপর নির্ভরশীল। 
৬. গবেষণা হাতিয়ার (Research Tools) হিসেবে কাঠামােবদ্ধ প্রশ্নপত্র (Structured Questionnaire), কাঠামােবদ্ধ সাক্ষাৎকার (Structured Interview) ও পরীক্ষণ পদ্ধতি (experiment) ব্যবহৃত হয়। 
৭. এই গবেষণার ফলাফল নিরপেক্ষ (Objective), নির্ভরযােগ্য (Raliable), যথার্থ (Valid) ও প্রতিনিধিত্বশীল (Generalised) হয়।


ইন্টারপ্রিটিভিজম প্যারাডাইম (Interpretivism Paradigm): 
সমাজের প্রতিটি মানুষ আলাদা এবং একেক জনের অভিজ্ঞতা একেক রকম। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং কোনাে কিছু দেখার উদ্দেশ্য ভিন্ন ভিন্ন এবং স্বাতন্ত্র। এজন্য ইন্টারপ্রিটিভিস্ট গবেষকগণ মনে করেন প্রত্যেকের জন্য একই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি একই রকম ভাবে কাজ করে না। সামাজিক কর্ম তত্ত্ব (Social Action Theory) থেকে এই পদ্ধতির উদ্ভব হয়েছে। এই ধারার গবেষকগণ মনে করেন মানুষের কর্ম (Action) বােঝার জন্য তার প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া প্রয়ােজন এবং তার দৃষ্টিভঙ্গি বােঝা প্রয়ােজন। একারণেই এই ধারাটি গুণগত তথ্যের (Qualitative Data) উপর নির্ভরশীল যেখানে উন্মুক্ত সাক্ষাঙ্কার বা অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ প্রয়ােজন।

ইন্টারপ্রিটিভিজম প্যারাডাইম এর বৈশিষ্ট্য

১. বেশিরভাগ সামাজিক বিজ্ঞান (Social Science) গবেষণার ধারণার কাঠামাে হিসেবে ইন্টারপ্রিটিভিজম প্যারাডাইম ব্যবহার করা হয়। 
২. গুণগত গবেষণা (Qualitative Research) সবসময় ইন্টারপ্রিটিভিস্টিক এপ্রোচ (Interpretivistic Approach) অনুসরণ করে কারণ তারা মানুষের স্বাতন্ত্র বা ভিন্ন ভিন্ন আচরণে বিশ্বাসী।
৩. এই ধরনের গবেষণার ব্যাপ্তি বা পরিসর সাধারণত ছােট হয়। 
৪. তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে গবেষণা নমুনার সাথে গবেষকের সম্পর্ক উন্নয়ন ও সহমর্মী হওয়ার ব্যাপার থাকে। গবেষক তথ্য প্রদানকারীর (respondents) প্রতি অনেক বেশি মানবিক আচরণ (Humanistic Approach) প্রদর্শন করেন। 
৫. এই গবেষণা গুণগত তথ্যের (Qualitative Data) উপর নির্ভরশীল। ৬. গবেষণা হাতিয়ার হিসেবে কাঠামােহীন/উন্মুক্ত প্রশ্নপত্র (Unstructured Questionnaire), কাঠামােহীন/উন্মুক্ত সাক্ষাত্তার (Unstructued Interview) ও অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ (Participant Observation) পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। 
৭. এই গবেষণার ফলাফল ব্যক্তি বিশেষের (Subjective) উপর নির্ভরশীল ও অনেক সময় প্রতিনিধিত্বশীল (Generalised) হয় না। এককথায় বলা যায়, পজিটিভিজম নিয়ন্ত্রিত হয় নিরপেক্ষতা, পরিমাপযােগ্যতা, পূর্বঅনুমানযােগ্যতা, সম্ভাব্যতা, নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ দ্বারা যা মানুষের আচরণকে পূর্ব-অনুমান করতে পারে। অন্যদিকে, ইন্টারপ্রিটিভিজম নিয়ন্ত্রিত হয় গবেষকের দ্বারা যা একটি বাস্তব পরিবেশে মানব আচরণ পর্যবেক্ষণ করে।

যদিও এই দুটি প্যারাডাইম বিপরীতধর্মী তারপরও বাস্তবে নিজ নিজ ক্ষেত্রে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি ও বৃদ্ধিতে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। মিশ্র গবেষণা প্যারাডাইম পজিটিভিজম ও ইন্টারপ্রিটিভিজম এর গতানুগতিক সীমাবদ্ধতা দূর করতে গবেষকগণ নতুন প্যারাডাইম এর সৃষ্টি করেছে, যা পজিটিভিজম ও ইন্টারপ্রিটিভিজম এর সমন্বয়ে গঠিত। এটি হলাে মিশ্র গবেষণা প্যারাডাইম। এই প্যারাডাইম এ গবেষকগণ নিজেদের প্রয়ােজন অনুযায়ী গুণগত ও পরিমাণগত গবেষণার ধারণা, পদ্ধতি, কৌশল, ভাষা ব্যবহার করে থাকেন।
 
গবেষক নিজেই ঠিক করবেন তার গবেষণার প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য গুণগত ও পরিমাণগত গবেষণার কোন সবল দিকটি বেছে নিবেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একজন গবেষক তার গুণগত গবেষণার জন্য হয়তাে গবেষণার হাতিয়ার হিসেবে উন্মুক্ত সাক্ষাৎকার ও পর্যবেক্ষণ ব্যবহার করেছেন, কিন্তু তার লিটারেচার এর প্রয়ােজনে হয়তাে কাঠামােবদ্ধ প্রশ্নপত্র দরকার হলাে কিছু সংশ্লিষ্ট ফ্যাক্টর যাচাই এর জন্য। সে ক্ষেত্রে গবেষক তার গবেষণার প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য মিশ্র গবেষণা প্যারাডাইম ব্যবহার করতে পারবেন। মিশ্র গবেষণা প্যারাডাইম ব্যবহারের জন্য গবেষকের অবশ্যই পজিটিভিজম ও ইন্টারপ্রিটিভিজম প্যারাডাইম এর সবল ও দুর্বল দিক ও এর প্রয়ােগ সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান থাকতে হবে।

0/Post a Comment/Comments